জীবন যা চায়
জীবন যা চায়

জীবন যা চায়
জুলফিয়া ইসলাম

ডাক্তারের কথা ভাবলেশহীন মনে শুনছে মেয়েটি। একুশ বাইশ বছরের জীবনে ডাক্তারের কাছেই যায়নি কখনও। মেয়েটির নাম মাজেদা। ড্যাবড্যাবে চোখে দেখছে ডাক্তারকে। বেশ সুন্দরী মেয়েটি। গায়ের রঙ দুধেআলতা। কাক-স্বচ্ছ একজোড়া কাজল টানা চোখ। তার সাথে মানানসই তটরেখার মতো জোড়া ভুরু। লিপস্টিকহীন কমলার ফালির মতো রসালো পুরু ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক করে এক দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারের কোনো কথা তার কানে ঢুকছে বলে মনে হয় না।
ডাক্তার বোধ হয় অনুমান করলেন বিষয়টা। তিনি একটু বিরক্ত হলেন, বললেন, কী হলো? এমন থ’ মেরে বসে আছ কেন? কী অসুখ হয়েছে বুঝতে পারছ?
না আফা পারছি না।
এতোক্ষণ যা বললাম তুমি বুঝতে পারনি?
না আফা।
তোমার জরায়ুতে টিউমার হয়েছে।
টিউমার কারে কয়, আফা?
মাংসপিণ্ড। বাচ্চাদানিতে মাংসপিণ্ড।
ও তাই কন্, মাংসের দলা? অহন বুঝবার পারছি। মাজেদা দাঁত বের করে হাসে। ঝকঝক করছে দাঁতের পাটি। যৌবনের তেজ আছে তাই চেহারাটি পুরোপুরি মলিন হয়ে ওঠেনি।
ডাক্তার মেয়েটিকে বুঝতেও পারছেন না। আশ্চর্য তো! ওর জীবনে কত বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে অথচ তার কোনো বিকার নেই। মেয়েটির বড় বড় চোখ দুটো মায়াময়। কিন্তু চোখের চাহনি নিষ্প্রভই লাগল পঞ্চাশোর্ধ্ব অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্ট রুবিনা আক্তারের। ওই চোখে কাজল আঁকা থাকলে হয়ত চোখের ঔজ্জ্বল্য বাড়তো। শিক্ষার আলো বঞ্চিত নিষ্প্রভ চোখের দৃষ্টিতে ভাষা থাকে না। অন্তত এই মেয়েটির নেই।
মাজেদা কাজ করে একটা গার্মেন্টসে। স্বামী পরিত্যক্তা। একটি কন্যাসন্তানের জননী হয়েছিল সে কিন্তু শিশুটি কোন অলক্ষ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছে। এখন সে একা। গার্মেন্টেসের এমডি জিনাত আরা তাকে কেন জানি খুব ¯েœহ করেন। আর তাই মেয়েটি জিনাত আরার পৃষ্ঠপোষকতা পায়। যেটা অন্য কোনো শ্রমিক কর্মী সচরাচর পায় না।
ডাক্তার রুবিনা আক্তার আবারও বললেন, অপারেশনের পর তোমার আর বাচ্চা হবে না। ভেবেচিন্তে দেখ, অপারেশন করবে কী করবে না?
মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ডাক্তার আফা আপনে যা ভালো মনে করেন তাই করেন।
ডাক্তার খসখস করে কলম চালিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। তারপর বুঝিয়ে দেন কিভাবে ওষুধ খেতে হবে এবং কখন আবার তার কাছে আসতে হবে। মাজেদা মনোযোগ সহকারে ডাক্তারের কথা সব শুনলো তারপর কাগজটা হাতে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসল।
হাসপাতালে অনেক মানুষের ভিড়। মাজেদা নিজের কথা ভুলে গিয়ে হাঁ করে মানুষের ভিড় দেখছিল। পিছন থেকে একজন রাগত স্বরে বলল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পথ ছাড়ো।
মাজেদা তার পথ ছেড়ে দাঁড়াল। করিডোরে এতো মানুষের ভিড় দেখেও ওর ভিতরে কোনো অনুভূতি কাজ করে না। চতুর্দিকে সবাই ছোটাছুটি করছে। মাজেদার কোনো ব্যস্ততা নেই। তার আজ ছুটি। কর্মক্ষেত্র থেকে সে আজ ছুটি নিয়েছে। কাই আজ কাজে যাওয়ার তাড়া নেই। তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফেরারও দরকার নেই।
সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে কাঁচা সুপারি দিয়ে এক খিলি পান কিনে খেল। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পর ও কোনো রিক্সা খুঁজে পেল না। একটা মুখপোড়া রিক্সাওয়ালাও রায়ের বাজার যেতে চাইল না। সে ভাবছিল বাসে করে যাবে কিন্তু কোন বাসটা যে কোথায় যায় সেটা তো তার ঠিক জানা নেই। যদিও রাস্তার মধ্যে হাজারো ধরনের বাস হুটোপুটি করে যাওয়া আসা করছে। নতুন বাস আছে, আবার একেবারে ভাঙাচোরা বাস আছে। এগুলো দেখলে মনে হয় যেকোনো সময় রাস্তার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষের প্রাণ নেবে। মাজেদা ভাবে এগুলোকে পুলিশ ধরে না কেন। এগুলো তো বাস না মড়ার গাড়ি। কত সুন্দর সুন্দর বাস চলছে রাস্তায়। লাল সবুজ নীল, বড় ছোট, দোতলা বাসও চলছে। দোতলাবাসে তার চড়তে খুব ইচ্ছা করল। কিন্তু কোথায় নিয়ে যে নামাবে পরে একটা ঝামেলাই হয়ে যাবে। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। এমন সময় হঠাৎ পাশ থেকে শুনতে পেলো, ম্যাডাম কই যাইবেন?
ও চমকে ফিরে তাকায়। এক ভ্যানওয়ালা তাকে ম্যাডাম বলেছে। ঢাকা শহরে বড়লোকের বউদের ম্যাডাম ডাকা হয়। ভ্যানওয়ালা ওকে কেন ম্যাডাম ডেকেছে ও বুঝতে পারল না। জিনাত ম্যাডাম ওকে একশ টাকা দিয়েছেন। বলেছেন, এটা তোমার গাড়িভাড়া আর ক্ষিদে লাগলে কিছু কিনে খাবে। একা একা কিছু খেতে ওর ভালো লাগে না। ওর মেয়েটি যদি বেঁচে থাকত তাহলে তার বয়স এখন পাঁচ বছর হতো। ও বেঁচে থাকলে ওকে নিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ করা সম্ভব হতো না। অবশ্য ওর দাদি বেঁচে থাকলে মাজেদার ওকে নিয়ে ভাবতে হতো না। যাক সেসব কথা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর মাথা গরম হয়ে যায়। এমন সময় ভ্যানওয়ালা একেবারে কাছে এসে বলল, কই যাইবেন, কইলেন না?
মাজেদা চুপ করে থাকে। অর্ধবয়সী লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখে। মাথার চুল কিছুটা পাকা। গায়ে সবুজ রঙের গেঞ্জি। পরনে সবুজ চেক একটা লুঙ্গি। লোকটিকে দেখে তার কেমন জানি মায়া হয়। হঠাৎ করে তার স্বামীর কথা মনে পড়ে যায়। ওর স্বামীর চেহারা আরও রুক্ষ ছিল। লোকটির চেহারায় একটা ভালোমানুষী ভাব রয়েছে।
ভ্যানে কইরা আমি যাইতে পারুম না। আমার কাছে রিকশা ভাড়ার ট্যাহা আছে। মাজেদা লোকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ভ্যানওয়ালা এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার বলল, আমি তুমারে পৌঁছাইয়া দিমু। রিকশার আশায় কতক্ষণ খাড়াইয়া থাকবা।
আফনে আমারে নিতে চান ক্যান? মতলবডা কী?
মতলব আমার কিছুই না। এই শহরে আমার কেউ থাহে না। বউ পোলাপান দ্যাশে। তুমারে দেইখ্যা আমার ওগো কথা মনে পড়ছে।
মাজেদা বলল, আমি রায়েরবাজারের বস্তিতে যামু। আমি বিশ ট্যাহার বেশি দিতে পারুম না।
ওইতেই চলব। উইঠা বও।
মাজেদা যেন আদেশ পালন করল। চালকের পিছনে বাম পাশে পা ঝুলিয়ে বসল।
ভ্যানওয়ালা প্যাডেল মারা শুরু করল। তারপর একসময় নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমার নাম বাদশা মিঞা। কিন্তু কামে বাদশা না। চালাই ভ্যানগাড়ি। তোমার নাম কি?
মাজেদা।
তোমার লগে কে থাহে?
আমার খালা।
তুমি হাসপাতালে আইলা ক্যান?
আমার খুব কঠিন অসুখ। ডাক্তার দেখানে এসেছিলাম।
কি অসুখ?
আমার টিউমার অইছে।
টিউমার হইছে, কোথায়?
বাচ্চাদানিতে।
কও কী!
মাজেদা আর উত্তর করে না।
বাদশাহ মিঞা পিছন ফিরে একবার মাজেদাকে দেখল। মাজেদার বিষণœ ফর্সা মুখ তার মস্তিষ্কে আটকে গেল।
মেয়েটির সাথে যেন আবার দেখা হয় এর উপায় বের করার চিন্তায় মশগুল হয়ে কথা বলতে ভুলে গেল বাদশাহ মিঞা। বস্তির কাছে এসে মাজেদাকে নামিয়ে কৌশলে তার থাকার অবস্থানটা জেনে নেয়। মাজেদা তাতে মনে কিছু করে না। রাস্তায় আসতে আসতে অনেক কথা ইতোমধ্যে হয়েছে তাদের মধ্যে। সে নির্দ্বিধায় তার অবস্তানের ঠিকানা দিয়ে হালকা করে তাকে একবার নিমন্ত্রণও করে বসে। বলে, সময় পাইলে আইসেন।
বস্তিতে ফিরে মাজেদা লোকটির কথা ভাবে। লোকটিকে না পেলে ও হয়ত আরও দেরি করে বাড়ি ফিরত। এখন মনে হচ্ছে বস্তির ওই খুপরি ঘরে তার একজন খালা আছে। আর আছে গার্মেন্টসের মালিক জিনাত ম্যাডাম। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যত কঠিন রোগই হোক না কেন তার খরচ তিনি বহন করবেন। তিনি তাকে একা একা হাসপাতালে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছেন। উনি বলেছেন, যার কেউ নেই তার নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়।
মাজেদা ঘরে ঢুকতেই খালা জিজ্ঞেস করেন, কী অইছে তর?
কী আর অইবো, বাচ্চাদানিতে টিউমার হইছে। অপারেশন করতে হইবো। ডাক্তার ম্যাডাম কইছে টিউমার কাইট্যা হালাইলে আর বাচ্চা অইবো না।
এই তুই কী কইতাছস? বাচ্চা না অইলে তুই মা অইবি ক্যামতে?
মা অওন লাগতো না।
তুই ভাইবা চিন্তা কইতাছস তো?
হ, ভাইবাই কইতাছি। আমার সোয়ামি, পুতের দরকার নাই। আমার অহন বাঁচন চাই।
মাজেদা মাটিতে বসে পড়ে। ওর কিছু ভালো লাগে না। মেয়ের জন্মের দুঃসহ সময়টুকু মনে পড়ে। মাজেদা ছিল ওর স্বামীর তিন নম্বর বউ। বড় বউ বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায়। দ্বিতীয় এবং ছোট বউ নিয়ে লোকটির সংসার। লোকটি মদুড়ি এবং জুয়াড়ি। বিয়ের আগে সে জানতে পারেনি। শাশুড়িও ওর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতো।
পনের বছরের কিশোরীর নিজের ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। প্রতি রাতে স্বামীর যন্ত্রণা ওকে মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। এই যন্ত্রণার মাঝে শরীরের চাহিদা বোঝার আগেই সন্তান পেটে এলো। যেদিন ওর সন্তান হলো সেই প্রসব বেদনার সময় কেউ পাশে ছিল না। শুধু ছোট ননদটি পাশে এসে বলল, কী হয়েছে ভাবি?
প্যাটে ব্যথা রে ভাই। অনেক ব্যথা। কিছু ভালা লাগছে না। অনেক ক্ষিধা লাগছে। কিন্তু খাইতে ইচ্ছা করছে না।
ননদ বলল, ভাবি ভাত আইনা দিতাছি।
না ভাত খামু না, চা খামু, একটু চা আইনা দাও।
মাজেদাকে চা খেতে দেয় না ওর শাশুড়ি। হাত থেকে থাবা দিয়ে চায়ের কাপ ফেলে দেয়। অভুক্ত মাজেদা ব্যথায় কাতরাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটি মেয়ে শিশুকে প্রসব করে। শিশুটির গলায় নাড়ি পেঁচানো দেখে মাজেদার মনে হলো বাচ্চাটি খুব কষ্ট পাচ্ছে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাজেদার অনুভূতি পুরোপুরি লোপ পায়।
যখন জ্ঞান ফিরে আসে ততোক্ষণে মেয়েটিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়ে গেছে। সে রাতে তার স্বামী ছিল বাড়ির বাইরে। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ি তাকে গরম ভাত দিয়ে যায়।
ভাতের থালা সে একপাশে ঠেলে রেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। তার কান্না শুনে কেউ এগিয়ে আসে না।
সেই থেকে জীবনযুদ্ধ কীÑ মাজেদা বুঝতে শিখে। বছর না ঘুরতেই তার স্বামী আবার বিয়ে করে। যেদিন নতুন বউ বাড়িতে এলো সেদিনই মাজেদা বাড়ি ছাড়ে। এরপর থেকেই তার শহরকেন্দ্রিক জীবন শুরু হয়।
কম বয়সী মেয়েটি নতুন করে আর জীবন শুরু করেনি। একই জীবনের পুনরাবৃত্তি সে চায় না। শরীরের সুখ না বুঝতেই বঞ্চিত হলো জীবন। জীবনের ঘোলা জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে এখন আবার নতুন সমস্যা হলো টিউমার। জিনাত ম্যাডাম ওকে কথা দিয়েছে ওর সমস্ত খরচ বহন করবে।
পাঁচদিন পর জিনাত ম্যাডামসহ ও হাসপাতালে আসে। গাইনির ডাক্তার রুবিনা আখতার জিনাতকে বললেন, ওর এখন যে পজিশন অপারেশন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অপারেশনের খরচের ব্যবস্থা করতে হবে।
জিনাত আরা মৃদু হাসলেন। বললেন, আমি ছাড়া ওর আর কোনো গতি নেই, আপনি ব্যবস্থা করেন। তারপর মাজেদার দিকে তাকালেন।
মাজেদার চোখে নীরব সম্মতি কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। ওর জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে মনে হয় ও অনুধাবন করতে পারছে না।
মাজেদা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ডাক্তারের সামনে বসে রইল। আবার যদি সে মা হতে না পারে সে জন্য মাজেদার কোনো অন্তরদাহ নেই। মাজেদার অভিব্যক্তিতে জিনাত আরার মনে হলো সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মেয়েটির অভিমান প্রকাশ পাচ্ছে। বাল্যবিবাহ, সন্তানের মৃত্যু, শরীরের কষ্ট, পরিত্যক্ত স্বামী সবকিছুর বিরুদ্ধেই মনে হচ্ছে তার বিরাট প্রতিবাদ।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ওর জন্য একটি বেড বরাদ্দ হলো। বেডে শুয়ে শুয়ে মাজেদা ভাবছিল, বৃদ্ধ বয়সে ওর কীভাবে কাটবে? ওর তো আর সন্তান হবে না। তাকে কে দেখবে? জিনাত ম্যাডাম আর কতদিনই বা তাকে দেখবেন। তার তো আপন বলে কেউ থাকবে না।
জিনাত আরা ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অভয় দিয়ে বললেন, তোমার কোনোরকম প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। কোনো চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি।
হাসপাতালের বিছানায় একা একা শুয়ে মাজেদার ভ্যানওয়ালাকে খুব মনে পড়ল। মনে মনে ভাবল, লোকটি যদি তাকে হাসপাতালে দেখতে আসতো। ওর মন খারাপ হয়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। মন খারাপ করে কী লাভ? লোকটি তো তার কেউ না। পথের মানুষ পথেই হারিয়ে যাবে। এখন একমাত্র জিনাত ম্যাডাম ছাড়া তার আর কেউ নেই।
হঠাৎ পাশের বেড থেকে সে চিৎকার শুনতে পায়। মাজেদা সচকিত হয়ে আয়াকে জিজ্ঞেস করে, কী অইছে মাইয়াডার?
কী আর অইবো টেরাকের তলে পড়বার চাইছিল। অল্পের লাইগ্যা বাঁইচা গ্যাছে।
মাজেদা ভাবে সেও কেন ট্রাকের নিচে পড়ল না? পরক্ষণেই মনে হলো কার জন্য মরবে সে? পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ না। ভালো মানুষ ও খুঁজে বের করবে। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করবে। নিজের ভিতরের অস্থিরতাকে শান্ত করতে চেষ্টা। একসময় মেয়েটির চিৎকার ওকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ঠিক সেসময় বাদশাহ মিঞাকে আসতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে।
হাতে বিস্কিটের প্যাকেট আর কয়েকটা কমলা নিয়ে বাদশাহ মিঞা সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি যে হাসপাতালে এইডা জানলেন ক্যামতে?
তুমার খালার কাছে।
মাজেদা বলল, এইগুলান ক্যান আনলেন? দুই বেলার কামাই শ্যাষ করলেন? দ্যাশে বউ পুলাপান না খাইয়া থাকব।
অগোর ব্যবস্থা করেই তুমার জন্য আনছি। তুমার এখন ফল খাওয়া দরকার। অপারেশনে অনেক রক্ত যাইব। ফল খাইলে রক্ত অইবো।
আরও রক্ত লাগলে কী করবেন?
বেবাক ভ্যানওয়ালারে লইয়া আমু।
আপনি আর কতজনের লাইগা এরহম করছেন?
কারো লাইগা করি নাই। খালি তুমার লাইগাই করতাছি।
বাদশাহ মিঞার কথা শুনে মাজেদা হেসে ওঠে। তার কেন জানি বাদশাহ মিঞাকে ভালো লাগে। সে বাদশাহ মিঞাকে বসতে বলে। তারপর দুজনে গল্প করতে থাকে। মাজেদার দুঃস্বপ্নগুলো উড়ে যায়। ওর নতুন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে। অনেকদিন পর ওর খুব ভালো সময় কাটে। লোকটি কোনোরকম অসভ্যতা ওর সঙ্গে করেনি। ওর শরীর স্পর্শ করেনি। ওর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়নি। বাদশাহ মিঞার সঙ্গ মাজেদার খুব ভালো লাগে। অল্প সময়ের মধ্যে মাজেদা যেন জীবনের অনেকখানি পেয়ে যায়। মাজেদার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। ওরা দুজনে গল্প করতে থাকে। সময় বয়ে যায়। দুজনের কারোরই সেদিকে ভ্র“ক্ষেপ নেই। বাদশা মিঞা যখন ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যায় ওর মনটা হাহাকার করে ওঠে। এই বুঝি সব হারিয়ে গেল।
বাদশা মিঞা যেন মাজেদার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে, তুমি যতদিন হাসপাতালে থাকবা আমি ততদিনই আসব। তুমি নিজেকে একা ভেবো না। আমি তোমার পাশে থাকব।
মাজেদা ভাবতেই পারছে না অসুস্থতার সময় এমন একজন সুহৃদ ওর পাশে থাকবে। ওর এখন হাসপাতালের সবকিছুই ভালো লাগছে। ডাক্তার, রোগী, নার্স সবকিছুই।
ঠিকভাবেই ওর অপারেশন হলো। অপারেশনের পর মাত্র এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। বাদশা মিঞা যোগাড় করে দিয়েছে। অপারেশনের দিন জিনাত আরা ছিলেন। তারপর একদিন এসে দেখে গেছেন। বলে গেছেন যতদিন সে সুস্থ না হয় ততদিন ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে না। কোনো চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। মাজেদা ভাবে পৃথিবীতে মাজেদা আপার মতোও মালিক আছে।
হাসপাতালে এক সপ্তাহ থাকার পর সে ছাড়া পেল।
বাদশা মিঞা ওকে নিতে এলো। মাজেদা বলল, আইজ থাইক্যা আমি মুক্ত।
কীসের মুক্তি তোমার?
আমার আর ভয় নাই। আমি আর বানধা পড়–ম না। ইচ্ছা মতো চলবার পারুম। মা হওন লাগবো না। বলেই উন্মাদিনীর মতো হাসতে থাকে।
আস্তে হাসো মানষে হুনবো।
হুনুক। আমি হোনাইতে চাই। এই জীবন আমারে কিছু দ্যায় নাই। জীবন আমার থেইক্যা স্বামী, সন্তান, সংসার হেই লগে বাইচ্চাদানি সব কাইড়া নিছে। যাউকগা, আমি অহন কিছুই চাই না। চাই শুধু মনের সাধ মিটাইতে।
মাজেদা বাদশাহ মিঞার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বাদশা মিঞা মাজেদার হাত চেপে ধরল। মাজেদার অনুভবে সে হাত বড়ই উষ্ণ আর দৃঢ়। এইরকম প্রত্যয়ী হাতেই তো সে নিজেকে সমর্পণ করতে চেয়েছে।

ঈদ সংখ্যা, যায়যায়দিন, সেপ্টেম্বর ২০০৮।

Share:

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X