আঠারো অক্টোবর
আঠারো অক্টোবর

আঠারো অক্টোবর
জুলফিয়া ইসলাম

রাসেল এখন খুব একা। সে পায়ে চলা মেঠো পথে হেঁটে বেড়ায় গাছগাছালির কাছাকাছি। একা থাকাটা ওর ছোটবেলা থেকেই খুব পছন্দের। খেজুর গাছের পাতা নিয়ে ও খেলা করে। গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। শীত মৌসুমে শিশির বিন্দুর কচুর পাতায় টুলটল করে, তার দেখতে খুব ভালো লাগে। উপর দিকে তাকালেই পাতা থেকে শিশির বিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে কপালে।
পথের ধারে টিনের বাড়ি। কী সুন্দর রোদ পড়ে টিনের চালে। আলোর প্রতিফলন ঠিক যেন শাণিত তরবারি। তারই ফাঁকে গাছগুলো সবসময় যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব রাসেল উপভোগ করে, দেখতে ভালোবাসা। ঘুঘু পাখি দেখলেই আজকাল রাসেল বড্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ডানার নিচে কী সুন্দর গয়না আঁকা।
বাড়ির পাশে ঝোপ ঝাড়ে ঘুরে বেড়ায় রাসেল। ক্লান্তিহীন হেঁটে বেড়ানো ইদানীং নেশায় পরিণত হয়েছে। এসব ভাটফুলের ছড়াছড়ি মাখা বাগান কী স্নিগ্ধ। ভারি মিষ্টি গন্ধও আছে এদের। রাসেল ওগুলোর গায়ে হাত ছোঁয়ায়, হঠাৎ একঝাঁক প্রজাপতি উড়ে চলে যায়। ওদের পাখায় এত আলপনা কে এঁকে দিলো! এত সুন্দর নকশা কে করেছে?
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কত্তো সব বন্ধু তার জন্য অপেক্ষা করে। ধানমÐির বত্রিশ নম্বর বাড়ির ছেলেটিকে সবার খুব পছন্দ। পরিবারের সবার ছোট সে। তাই বাবা-মা আর ভাই-বোনদের আদরের ছোট সদস্য সে। ওর বাড়ির সবাই ওকে কত্তো ভালবাসে। তাই আঠারই অক্টোবর দিনটি এলেই সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। হাসু আপা আর রেহানা আপা তাকে একটু বেশি রকমই ভালোবাসে। মা বলেছেন হাসু আপার ঘরটিতেই তার জন্ম হয়েছিল।
আজ আঠারো তারিখ। রাসেলের মনে হচ্ছে প্রজাপতিরা এটা জেনে ফেলেছে। প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি ওকে এক পৃথিবী ভালোবাসায় সিক্ত করে রেখেছে। রাসেলের ভাবনাগুলো ওই রঙিন ডানায় ভর করে উড়তে থাকে দিগি¦দিক। আজ তার জন্ম দিন। ওর দুই-একজন বন্ধু বিষয়টি জানে। ফুল পাখি আর প্রজাপতিরাও বিষয়টি কিভাবে যেন জেনে যায়। প্রজাপতিদের সাথে ঘাস ফড়িঙদেরও রয়েছে এক অদ্ভুত সখ্যতা। চুপি চুপি ওদের ফিসফাস গুঞ্জন কানে লাগে। রাসেল থতমত খেয়ে যায়। সহসা তার মুখ থেকে কথারা হারিয়ে যায়। প্রজাপতি আর ঘাসফুলদের তার বন্ধু মনে হয়। ইচ্ছেরা সব ডানা মেলে দেয়। ইচ্ছে করে ওদের সাথে আকাশে উড়ে বেড়াতে। সে বেমালুম ভুলে যায় নিজেকে।
রাসেল ভাবনায় পড়ে যায় বাবা-মা ভাইবোনরা তার জন্য অপেক্ষা করবে। হাসু আপার ইচ্ছেতেই বাবা জন্মদিন পালন করেন। বাবা বলেন, বড় হয়ে মানুষ হয়ে ওঠো বাবা। কর্মই তোমাকে সব সময় ঠিক পথে রাখবে। বাবার কথাগুলো রাসেলের খুব ভালো লাগে।
বাংলাদেশ, চিরসবুজ বাংলাদেশ। সবুজ ফড়িংদের সাথে মিলে মিশেই এই দেশে ও থাকবে। ওরা সব ওর বন্ধু। নদীতে পালতোলা নৌকাও তার খুব প্রিয়। মাঠ ঘাট জনপদ সবকিছুই তার অতি আপন। মধুমতী নদীতে পাল তোলা নৌকা তার অতি প্রিয়। নৌকার মাঝিদের দাঁড় বেয়ে নৌকা বাওয়া খুব পছন্দের। ভালো লাগে তার। মধুমতীর পাড়ে এই টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, তার পিতৃপুরুষের ভিটা। বত্রিশ নম্বর বাড়ির বাইরে বেড়াতে এনে মা তাকে টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যান। সেখানে তার খুব ভালো দিন কাটে।
রাসেলের সাইকেল চালাতে অনেক ভালো লাগে। মাঝে মাঝে চাকা পাংচার হয়ে যায়। তখন মনটা খুব খারাফ থাকে। হাসু আপা তাকে সান্ত¦না দেয়। পরের দিন সাইকেল সারিয়ে আনা হয়। ভাগ্নে জয় তাকে খুব পছন্দ করে। মামা যখন সাইকেল নিয়ে ঘুরে ও হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন সাইকেল চালাতে পারলে খুব আনন্দ থাকে সে। কিন্তু মা মাঝে মধ্যেই বকুনি দেন। বকুনি খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। যেদিন মা বকুনি দেন কিছুটা সময় পরেই আবার বুকে টেনে নিতেন।
আজ তার জন্মদিন। অথচ কেমন ভয়ের পরিবেশ বিস্তৃত হয়ে আছে তার চার পাশে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। হাসু আপা তাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন। রেহানা আপু কেক কাটার ব্যবস্থা করেছেন আজ। কিন্তু বত্রিশ নাম্বার বাসায় সে এখন আর থাকতে পারে না। এখানে তার কত স্মৃতি মিশে আছে। এটা আজ জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। তার প্রাণ প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রক্ষার জন্য?
হাসু আপা আজ বড় বড় মঞ্চে বক্তৃতা দেন। তার মনের কথা মানুষদের শোনান। রাসেল প্রজাপতিদের মতো বাতাসে ভাসতে ভাসতে তাঁর কথাগুলো শোনে। বেশি ভারী ভারী কথা শুনলে আর বুঝতে পারে না সে। জন্মদিনের আয়োজন, কেক কাটা এসব আর ভালো লাগে না কিছুতেই। কেউ তো আর তাকে দেখতে পায় না!
আজ তার কত তম জন্মদিন? আঠারোই অক্টোবর। হাসু আপা ও রেহানা আপা তাকে একসাথে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। ওদের কণ্ঠে কান্না জড়ানো Ñ রাসেল ভাইটি তুই কোথায়?
রাসেল সব শুনতে পায়। কিন্তু তার কিছুই করার থাকে না। ওর দু বোনের ডাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তর আর পাখ পাখালির গানে গানে।
রাসেল নেই। রাসেল নেই। কে বলেছে রাসেল নেই? সে তো সারা দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কখনো ঘাস ফড়িংয়ের তো কখনো প্রজাপতির পিঠে চড়ে ফুলে ফুলে গান গেয়ে।

Share:

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X