সংস্কৃতি
সংস্কৃতি

সংস্কৃতি
জুলফিয়া ইসলাম

সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায়? সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা সবমসয় একরকম থাকেনি। তবু নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তা এখন একটা জায়গায় সংহত হয়েছে। কোনো এক সময় সংস্কৃতির নির্মাতা বা নিয়ামক হিসেবে রক্ত বা রেসিজম বা জাতিতত্ত¡কেই গুরুত্ব দেয়া হতো। এডলফ হিটলার বিশ্বের শ্রেষ্টতম সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে বিশুদ্ধ নর্জিক আর্য জাতির কথা বলেছিলেন। অন্য কোনো এক সময় জলবায়ু, ভৌগোলিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতিকে সংস্কৃতি গঠনের প্রধান উপাদান রূপে বিবেচনা করা হয়েছিল। সংস্কৃতি গঠনে ও সেই সূত্রে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিকাশে সামাজিক আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, জীবিকার উপায়, শিল্প-সাহিত্য-ললিতকলা, পালা-পার্বণ-উৎসবাদিসহ জীবন উপভোগের যাবতীয় ব্যবস্থা যে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল সে-সত্যের প্রতি আগে তেমন দৃষ্টি দেয়া হয়নি।
একেবারে গোড়ার দিকে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল নানা কৌমভিত্তিক অস্ট্রোনির্যোয়েড-আলপাইন-মোঙ্গল-দ্রাবিড় প্রভৃতি অনার্য শ্রেণির লোক। আর্য পণ্ডিতগণ এদের তুচ্ছ করে বলেছেন ‘অসুর’ আর এদের ভাষাকে ছিহ্নিত করেছেন, ‘অসুর ভাষা’ বলে। কিন্তু ওই ভাষাই বাংলাভাষা, আর এই ভাষাভাষী অঞ্চলের অধিবাসীরা সেই প্রাচীন যুগেই পরিণত হয়েছিল একটা মিশ্র তথা বর্ণসঙ্কর জাতিতে। শুধু যে রক্তের মিশ্রণ ঘটেছিল তাই নয়, অ্যানিমিজম, প্যাগানিজম, বৌদ্ধমত প্রভৃতির মিশ্রণে একটি সমন্বিত লোকধর্মও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আধুনিককালে নেশান বা জাতি বলতে আমরা যা বুঝি তা তখন পর্যন্ত এই মানুষরা হয়ে ওঠেনি। সেই বিশেষ দিক থেকে জাতীয়তাবাদের চেতনা বাংলায় কেন ভারতবর্ষের কোনো অংশেই তখন অবধি বিকশিত হয়নি।
বর্তমানে মনোবিজ্ঞানী, আচরণবাদী, সমাজতাত্তি¡ক ও নৃতত্ত¡ বিশেষজ্ঞগণ যে ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন আমরাও তাকেই গুরুত্ব দেই। অর্থাৎ কোনো একটি জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস, জীবিকা অর্জনের পদ্ধতি, সামাজিক উৎসবাদি, সংস্কার-কুসংস্কার, তাদের জীবনের হাজারো উপকরণ ও উপাচার, তাদের ভাষা সাহিত্য সঙ্গীত চিত্রকলা নৃত্য ইত্যাদি মিলে তার সংস্কৃতি নির্মিত হয়। এসব কিন্তু সর্বদা সমান গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সমান প্রভাববিস্তারী হয় না।
যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার সংগ্রামী বিকাশের ফলে আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, তা ওই রকম ইতিহাসের জীবন্ত শক্তিসমূহের একটি ফসল, একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কনসেপ্টের বাস্তব রূপায়ণ।
আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্র শুধুমাত্র কোনো জনগোষ্ঠীর একাত্ববোধ ও ইচ্ছার ভিত্তিতেই সৃষ্টি হতে পারে না, তাকে অপেক্ষা করতে হয় অনুকুল পরিবেশের জন্য, সুযোগের জন্য, সমাজের ঐতিহাসিক লগ্নের জন্য।
জাতীয়তাবোধের উৎপত্তি হয় একাত্ববোধ থেকে এবং এই একাত্ববোধ গড়ে ওঠে বহু কিছু ভিত্তি করে। তার মধ্যে ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক পরিবেশ বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। প্রধানত এসব ভিত্তি করেই একটি অঞ্চলের মানবগোষ্ঠী সচেতনভাবে নিজেদের এক মনে করে, অন্যদের চাইতে স্বতন্ত্র বিবেচনা করে এবং স্বনির্ধারিত পথে নিজেদের বিকশিত করে তুলতে চায়। গোষ্ঠী সচেতনতা হিসেবে জাতীয়তাবাদ তাই একটি মনস্তাত্তি¡ক ও সমাজতাত্তি¡ক সত্য, কিন্তু এই সংজ্ঞা জাতীয়তাবাদের জটিলতা ও বহুমাত্রিকতার পরিচয় পুরো স্পষ্ট করে তুলে ধরে না।
কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে একগুঁয়েমির বশবর্তী হয়ে কোনো বিশেষ উপাদানকে মুখ্য বলে চিহ্নিত করলে, সর্বাবস্থায় সর্বকালের জন্য কোনো একটিমাত্র উপাদানকে নিরঙ্কুশ অগ্রাধিকার দিলে বিভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং তার ফলে জন্মলাভ করে নানা অশুভ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।
পাকিস্তান আমলে উপনিবেশবাদী শোষণের স্বার্থে ইসলামের প্রতি ভালোবাসার কারণে নয়, তার শাসকচক্র সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির স্বাভাবিক স্রোতধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
ইতিহাাসের আয়রনি এখানে যে তাদের জঙ্গি কর্মকাণ্ড বাঙালিকে আরো প্রতিবাদী করে তোলে, তার সাংস্কৃতিক চেতনায় একটা নতুন সংগ্রামী দ্যোতনা যুক্ত করে এবং তার জাতীয়তাবাদী বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। সেই ইতিহাস ও তার চূড়ান্ত পরিণাম তথা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয় স্বাধীন-সার্বভোম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কথা সর্বজনবিদিত।
জীবিকাগত ও বাস্তব উপকরণগত অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং তার হাত ধরে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণের বিষয়টি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। অর্থনৈতিক বিকাশধারা যখন ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করে তখনই সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। তখন পল­ী ও নগরের ব্যবধান হ্রাস পায়, লোক-সংস্কৃতির সঙ্গে নগর-সংস্কৃতির একটা স্বাভাবিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে, (আমাদের এখান আজকের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার অবস্থান সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে যে কৃত্রিম যোগসূত্র গড়ে তোলার কূট প্রয়াস চালানো হচ্ছে, সে-রকম নয়) এবং তখন বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গেও তার রাখিবন্ধন ঘটে।
একটা কথা আমাদের মনে রাখা ভালো। বর্তমানে কোনা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির আদি, অকৃত্রিম, বিশুদ্ধ ও অবিমিশ্র রূপ অকল্পনীয়। বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে নানারকম গ্রহণ-বর্জন ও সমন্বয়ে তার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ও উঠছে। বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি বৌদ্ধদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা জানি যে বাঙালি মুসলমানের ধর্ম তথা ইসলাম তার সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয, এমনকি সর্বপ্রধান উপাদানও নয়।
বাঙালি তার আধুনিক সংস্কৃতিতে হয়তো চার আনা ইউরোপীয়, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে সে কতটা ইউরোপীয় হবে এবং আট আনা ভারতীয়, বাকি চার আনা সে বাঙালি এবং এই চার আনার মধ্যে আবার কতটা ভারতীয়ত্বের বিকার, বাকিটুকু খাঁটি বাঙালি অর্থাৎ গ্রাম্য বাঙালি।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাদেশে তার মাটির, পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব থেকে প্রাণরস আহরণ করে একান্তভাবে দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যলালিত হিন্দু-মুসলামন নির্বিশেষে একটা ইন্ট্রিগ্রেটের বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।
এবার আমরা বাঙালি মুসলামানের সংস্কৃতিও এই সূত্র ধরে তার আত্মপরিচয়ের সঙ্কট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলব। বাঙালি জাতীয়তাবাদিী চেতনা আজ যে স্তরে এসে পৌঁছেছে তা যথার্থভাবে উপলব্ধি করার জন্য এটা দরকার।
বাঙালির লোকসঙ্গীত, লোকগাঁথা, লোককাব্য, বাউল সাধনা ও গ্রামীন মেলাসহ নানা লোক উৎসবের মধ্যে আমরা তা লক্ষ করি। ধর্মীয় উগ্রতা ও রাজনৈতিক ক‚টবুদ্ধিজাত ভেদবুদ্ধি তকনো প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। চণ্ডীদাস লিখেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ উনিশ শতকের বাউল-কবি লালন শাহ লিখেছেন:
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসার
লালন ভাবে, জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।
যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনী চিনি কিসে রে।
কেউ মালা কেউ তসবী গলায়, তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায় জেতের চিহ্ন রয় কারুরে।’
সম্প্রদায়ভেদে, শ্রেণিভেদে, ধর্মভেদে, পেশাভেদে কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও জীবনযাপন রীতির ক্ষেত্রে উপর স্তরে দৃষ্টিগ্রাহ্য ভিন্নতা থাকলেও মৌল স্তরে নিবিড় ঐক্য ছিল। ব্যাপক গ্রামীণ জনযোষ্ঠীর আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে তলের দিকে বিদ্যমান এই মৌলিক ঐক্যই তখন সমাজকে বেঁধে রেখেছিল, তার সুস্থতা সুনিশ্চিত করেছিল এবং নানা বিচিত্র ও আকর্ষণীয় সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ সম্ভব করে তুলেছিল।

Share:

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0

TOP

X