শ্রাবণী
জুলফিয়া ইসলাম
ভাবি! বল এবার আমার কী হবে?
দুটো দিনও কি স্থির থাকতে পারিস না। এই তো সেদিন বাবলির সঙ্গে কত কী না হলো। কিন্তু কই কিছুই তো হলো না। এভাবে না বুঝে শুনে পাগলের মতো যার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো অর্থ হয় না। একটার রেশ না কাটতেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়লি?
ভাবি শুধু তোমাকেই জানিয়ে রাখলাম। সবাইকে তো আর সব কথা বলা যায় না। আর প্রতারিত হতে চাই না। ভাবি তুমি ওকে দেখলে থুব পছন্দ করবে। সত্যি বলছিÑ শ্রাবণ দিনের মতোই মেয়েটি। শ্রাবণ দিনের অবিরাম ঝরঝর বৃষ্টির মতো তার ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। তার সমস্ত মুখাবয়ব জুড়ে শরৎ মেঘের শুভ্রতা। তার মুখের ওপর দৃষ্টি পড়লেই বুকের ভিতর গুড়গুড় শব্দ হতে থাকে। তার চোখের শাণিত দৃষ্টি সমস্ত বুক চিরে ফালাফালা করে দেয়। একদম মরে যাবো ভাবি!
কীসে যে তোর বাঁচা আর কীসে মরা এসব বোঝার ক্ষমতা নেই বাপু। এসব বাদ দিয়ে ছবি আঁকায় মন দে। ভাবি এই জ্ঞান দান করে উঠে চলে গেলেন। রান্নাঘরে তার অনেক কাজ পড়ে আছে।
ভাবি চলে যাওয়ার পর সৈকত বাইরের প্রকৃতিকে দেখার জন্য জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। সমস্ত প্রকৃতি যেন চঞ্চল হয়ে রয়েছে। এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল বলে। মেঘে মেঘে কী অদ্ভুত আয়োজন।
তবু কী এক গুমোট আবহাওয়া ঘরের ভিতরের পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে রেখেছে।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। হ্যাঁ ও প্রান্তে তারই কণ্ঠ। মনের ভিতর এক প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সমস্ত তন্ত্রীতে রিমিঝিমি কম্পন। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির প্রবল তোড়ে সমস্ত শহর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কোনো ভ্র“ক্ষেপ নেই, ওরা দুজনে গল্প মাতোয়ারা। এক সময় শ্রাবণী ফোন রেখে দিতে চাইল। বলল, মা বাড়িতে নেই। রান্না কিছু হয়নি। বাড়িতে মা নেই বলে কিছু খাইওনি।
শ্রাবণী ফোন ছেড়ে দিলো। সৈকতের মনের ভিতরে ঝড়ের তাণ্ডবতা তাকে আরও এলোমেলো করে দিলো।
একা একা সময় কাটতে চায় না। সৈকতের বুকের ভিতরটা কী বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে? সে কী তবে বানের জলে ভাসছে? অস্থির সৈকত মনকে স্থির করার জন্য সিডিতে গান বাজায়Ñ ‘ভালোবেসে দুটি চোখ শ্রাবণ আকাশ হলো, তবু সে আমার হলো না।’
শ্রাবণী নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিতে বলেছে সৈকতকে। এই আব্দার নিয়ে শ্রাবণী সৈকতকে প্রায়ই ফোন করে। সৈকত কথা দিয়েছে প্রচ্ছদ এঁকে দেবে কিন্তু এখনও দেয়নি। ওর ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে। প্রচ্ছদ করে দেওয়ার পর শ্রাবণী যদি আর ফোন না করে!
শ্রাবণী ভালো লেখে। মূলত গল্প লেখে, কবিতা আর গানও নাকি লেখে। সৈকত তার লেখা গল্প পড়েছে। ভারি মিষ্টি ভাষার সৌকর্য। প্রচ্ছদ করার জন্য হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি তাকে দিয়েছিল। ঝকঝকে হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি পড়তে সৈকতের একটুও বেগ পেতে হয়নি। তার হাতে কলম যেন নাচের মুদ্রার মতো নাচে।
সেদিনের কথা মনে পড়ে সৈকতের। হঠাৎ অকল্পনীয়ভাবে শ্রাবণীর ফোন পায় সে। হ্যালো, সৈকত সাহেব আছেন?
জ্বি বলছি।
আমার নাম শ্রাবণী। লেখালিখি করি।
জ্বি আমি আপনাকে চিনি। আপনার বেশ কয়েকটা গল্প আমি পড়েছি।
সৈকতের পুলকিত কণ্ঠ শ্রাবণীর বেশ ভালো লাগে। আমিও আপনার আঁকা ছবি দেখেছি কয়েকটা। বেশ ভালো লেগেছে।
আমি লেখা পড়েছি। সাবলীল, কোনো জটিলতা নেই।
তাই? কিন্তু আমি তো বিখ্যাত নই। আপনি কি আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করে দেবেন?
সে তো আমার সৌভাগ্য।
সৈকত শ্রাবণীর বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছে। শ্রাবণীর খুব পছন্দ হয়েছে। মাত্র মাসখানেক হলো। এরই মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। বেশ ক’দিন দেখাও হয়েছে। প্রোগ্রাম করে। তারপর থেকে ইথারে কথা হয় নিয়মিত। এমন কী একা বিছানায় শুয়ে মনে মনেও। কামনা জাগে। শ্রাবণীরও কি তাই হয়!
প্রচুর বর্ষণে পৃথিবী ¯œাত হয়ে ওঠে। উদ্দাম শারীরিক প্রেম যেমন দেহকে ক্লান্ত করে তোলে। তেমনি সৈকতের কামনাসক্ত মন শ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার ঘুম আসতে চায় না। শ্রাবণী ওকে টানে। সে নিজের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে বাধ্য হয়ে শ্র্রাবণীকে ফোন করে। হ্যালো, আজ কি বাসায় মা নেই?
শ্রাবণী খিলখিল করে হাসে।
তার হাসির শব্দে মন ভরে যায় সৈকতের।
মা? প্রতিদিন কী আর মা আমাকে ফেলে চলে যাবে?
আপনার সঙ্গে গল্প করলে কোনো কথা মনে থাকে না।
খাওয়া-দাওয়া করেছেন?
গল্প করতে যেয়ে ভুলে গেছি।
সে কী? এখন খেয়ে নিন।
একটু পরে পাউরুটি দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নেব।
এমন বেখেয়ালি হলে কী চলে?
অকস্মাৎ শ্রাবণীর গলার স্বর খাদে নেমে গেল। সৈকতের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল।
একদিন বাসায় আসেন। শ্রাবণী আবার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল।
লেখিকার কণ্ঠস্বরের মুহুর্মুহু পরিবর্তন সৈকতের ভিতরে উথাল-পাতাল ঢেউ তোলে। কণ্ঠস্বরের মাদকতায় সৈকতের মনে নেশা ধরে। সৈকত নেশার ঘোরে বলতে থাকে, সেই দিনই তো কবিরভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা হলো।
সে তো বেশ কয়েকদিন আগে। একদিন সময় করে এদিকটায় আসুন। সৈকতের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কোনরকমে উত্তর দেয়, কবে?
আগামী পরশু। একটু থেমে বলে, এ কাজ আপনাকে ছাড়া হবে না।
কী… কী কাজ?
দেখা হলেই জানতে পারবেন।
শ্রাবণীর রিনরিনে হাসির শব্দ। সৈকতের বুকে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ফোন রেখে দিয়ে বালিশ কোলে নিয়ে উপুড় হয় শুয়ে পড়ল। ইস মাঘ মাসের এমন শীতে কান গরম হয়ে উঠল কেন?
সৈকত পরের দিন কেবল ক্ষণ গণনা করে সময় কাটিয়ে দিল।
মনের অবস্থা ভীষণ অস্থির থাকায় রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সে সকালে উঠে জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নিলো।
ভাবি তার প্রস্তুতি দেখে বললেন, কীরে এই সাত সকালে কোথায় চললি?
সৈকত কোনো উত্তর দিলো না। এত সকালে শ্রাবণীর বাসায় যাওয়া কি ঠিক হবে। তবু সৈকত রঙ তুলি ব্যাগে ভরে নিলো। শ্রাবণীর কাছে যেতে হবে। সৈকতকে ওর দরকার পড়েছে।